ছোট গল্প



গত তিন দিন যাবত প্রতিনিয়ত বোম্বিং চলছে। আজ শুক্রবার মুসলমানদের সাপ্তাহিক ঈদের দিন। অন্যান্য শুক্রবার মসজিদগুলো লোকারণ্যে পরিণত হতো। এ শুক্রবার একটু অন্যরকম। মুয়াজ্জিন অন্তর ঠান্ডা হয়ে যাওয়া সুরে সবাইকে আহ্বান জানায় নি- "নামাজের দিকে এসো, কল্যাণের দিকে এসো"। আর্মড ক্যারিয়ারের ইঞ্জিনের গম্ভীর শব্দে থুম মেরে আছে চারপাশ। মাঝে মাঝে অজানা কোন এক জায়গা হতে বেশি আসে আর্তনাদ আর আকুতি।

গত মাসে বোম্বিং এ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে সালেহদের দোতালা বাড়িটা। এর আগে ওদের পরিবারের সকলে রিফিউজি ক্যাম্পে চলে যায়। সালেহের দুই বোন যখন খুব ছোট তখন ওদের বাবা মারা যায়। তার মা, ছোট দুই বোন - ফারাহ ও রেবেকাকে নিয়ে ছোট্ট এক তাঁবুতে থাকছে তারা।

জানুয়ারি মাস চলছে। প্রচন্ড শীত। লেকগুলো জমে বরফে পরিণত হয়েছে।কনকনে ঠান্ডা বাতাস তাবুর নিচ দিয়ে শো শো করে ধুকছে। গা ধাকার চাদর পর্যন্ত নেই ওদের কাছে। কারণ বাড়ি ছাড়ার সময় শুধু মাত্র পড়নের কাপড় পড়ে বেরিয়ে ছিল তারা। বিশুদ্ধ পানি, পর্যাপ্ত খাবার, পয় নিষ্কাশন কোনো কিছুরই ভালো ব্যবস্থা নেই। তবুও হেরে যায় নি তারা।

শীতকাল পেরিয়ে গৃষ্মকাল এল। অবস্থা তেমন কোন উন্নতি নেই। দেখলে আর চেনা যায় না সালেহকে পরিবারের ভার যে বয়ে চলছে সে। জীবন সংগ্রামের খরস্রোতা নদীতে খড়কুটোর মতো গা ভাসিয়ে দিয়ে বেঁচে আছে সালেহ। ক'দিন পার পবিত্র ঈদ। ঈদে আগের মত পরিষ্কার কাপড়, মজার মজার খাবার, নানান পদের সেমাই আর মিষ্টি নেই। তাই ফারাহ আর রেবেকার মন কিছুটা খারাপ। যদিও ওরা কোন অভিযোগ করেনি তবুও ওদের চোখ যেন সব বলে দেয়। মানুষ কষ্ট সইতে সইতে এক পর্যায়ে অভ্যস্ত হয়ে পরে। কিন্তু সালেহের কষ্ট প্রতিবার আগের বারের চেয়েও কয়েক গুণ বেশি যন্ত্রণা দেয়। আর দিন দিন এই যন্ত্রণা বেড়েই যাচ্ছে। তার বোনদের এই কষ্ট সইতে পারছে না। কি করবে তাও বুঝে উঠতে পারছে না কারণ যেখানে এক বেলা ঠিকমত খাবার পাওয়া দুর্লভ সেখানে একটু বাড়িয়ে অভিজাত খাবার ত্ব বিলাসিতা মাত্র। সালেহের সামনে একটা পথই খোলা আর তা হল "দোয়া"। সে কোন এক খুতবায় শুনেছিল-"মাজলুমের দোয়া আর আল্লাহর মাঝে কোন প্রতিরোধক দেয়াল থাকে না" নীরবে-নিবৃতিতে মহান সত্তার দরবারে তার আকুতি আর চাপা পড়ে রইলো না। 

মহান আল্লাহ মহান তার ডাকে সাড়া দিলো। ঠিক তারপরের দিন বিভিন্ন এনজিও সংস্থা ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ক্যাম্প আসলো তাদের রিফিউজি ক্যাম্পে। দেশ-বিদেশের হাজার হাজার মানুষ এই সংস্থাগুলোকে আর্থিক অনুদান পাঠিয়েছে যাতে করে ফারাহ-রেবেকার মত হাজারো শিশু একটু হলেও আনন্দে ঈদ করতে পারে।সংস্থাগুলো রিফিউজি ক্যাম্পে প্রত্যেকটি পরিবারকে পর্যাপ্ত সামগ্রী আর বাচ্চাদের একটি করে নতুন জামা ও কিছু মিষ্টি দিল।এসব পেয়ে ফারাহ আর রেবেকার আনন্দ দেখে কে!যেন ওদেরকে আকাশের চাঁদ এনে দেওয়া হয়েছে । সালেহ ও একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। কিন্তু ঈদের পর দিনই ফারাহ আর রেবেকা খুব অসুস্থ হয়ে পরলো।প্রচন্ড জ্বর, মাথা তুলে দাড়াতে পারছে না কেউ।ওদের মা ওদেরকে আকড়ে ধরে আছে।সালেহ ওদের মাথায় পানি ধালছে, ওদের গা যেন একদম পুড়ে যাচ্ছে।না আছে হাসপাতাল, না আছে ঔষধ আর না আছে সালেহের কাছে অর্থ।চার দিন হয়ে গেল জ্বর কমার কোনো নাম নেই।পাগলের মত ছুটছে সালেহ।স্বেচ্ছাসেবী ক্যাম্পের এক ভাইয়ের সাথে দেখা সালেহের।তাকে সব খুলে বলার পর সে সালেহকে কিছু ঔষধ দিল। কিন্তু ওগুলো নিয়ে তাঁবুতে পৌঁছাতে অনেক দেড়ি হয়ে গেল যে।আর নেই এই মিষ্টি মেয়ে দুটো। সালেহের দুই চোখের মনি আর দুনিয়াতে নেই। পারি দিয়েছে আখিরাতের দিকে।শুরু করেছে নতুন যাত্রা।ওদের মা ওদেরকে যেন মুর্তির মত আকড়ে ধরে আছে।যেন তার কাছে সকলকিছু স্তব্ধ হয়ে গেছে।সালেহও এক কোণায় বসে তাকিয়ে আছে নিথর দেহ দুটির দিকে।পড়নে ঈদের সেই নতুন জামা, হাতে অবশিষ্ট কিছু মিষ্টির আঠা আর মুখে এক চিলতা হাসি যেন বলে দিচ্ছে "ধন্যবাদ ভাইয়া"।


এই গল্পটা এক রূপক কথা মাত্র। বাস্তবতা এর চেয়ে ও ভয়ঙ্কর। কোন বাস্তবতার গল্প শুনবেন??বরফে জমে মারা যাওয়া দুই বছরের রহমতুল্লাহ শিরবাকির নাকি কারাগারে বন্ধি আট বছরের ছোট্ট মেয়ের কোনো ঠিকানা ছাড়া তার বাবার কাছে লেখা চিঠির?এ অনাচার এবং যুলুম কাঠামোগত।তাই এ কাঠামো আর ব্যবস্থার পরিবর্তন ছাড়া এই অন্যায় থামবে বলে আশা করা যায় না। হয়তো সময়ের সাথে অত্যাচারিতের নাম বদলাবে,স্থান বদলাবে,কিন্তু মৌলিক কোনো পরিবর্তন নেই।যুলুমের ধারা চলতে থাকবে যেমনটা গত দেড়শ বছর ধরে চলছে।দেয়ালের লিখনি স্পষ্ট, সময়ের দাবি পরিষ্কার।

Comments

Post a Comment